38 C
Bangladesh
Monday, April 29, 2024
spot_imgspot_img
Homeপ্রতিবেদনশিশু কেন্দ্রের বর্বরতার বিচার হোক দ্রুত।

শিশু কেন্দ্রের বর্বরতার বিচার হোক দ্রুত।

ঘটনাটি ছোট নয়। কিন্তু হাজারো অস্বাভাবিক ও চাঞ্চল্যকর খবরের দেশে তা পাঠক-শ্রোতা-দর্শকের মধ্যে করুণার সৃষ্টি করেছে বলে মনে হয় না। আমরা জাল–জালিয়াতি, জোচ্চুরি ও মিথ্যার সঙ্গে বসবাস করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। শুক্রবারের পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল বৃহস্পতিবার যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ভেতরে কিশোরদের দুই পক্ষের সংঘর্ষে তিন কিশোর নিহত হয়েছে। ঘটনায় আহত হয়েছে ১৪ জন। এ ধরনের ঘটনায় যেখানে সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত, সাধারণত রাষ্ট্র যা করে তাই করা হয়েছিল। একটি তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এর মধ্যে নিহত কিশোরদের একজনের বাবা শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরা তাৎক্ষণিক উত্তেজনাবশত কোনো অঘটন ঘটাতে পারে। যশোরের পুলিশ সুপার প্রথম জানিয়েছিলেন, বিভিন্ন অপরাধে জড়িত দেশের বিভিন্ন জেলার ২৮০ কিশোর আদালতের মাধ্যমে ওই কেন্দ্রে এসেছে। তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধ রয়েছে। সেই বিরোধের জেরে সংঘর্ষ হয়েছে।

পুলিশ ও শিশু কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষের বয়ান অবিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না। বাংলাদেশে যেখানে জনাকয়েক মানুষ বাস করে, সেখানে একাধিক পক্ষ আধিপত্য বিস্তারে লিপ্ত হবে না, তা অবিশ্বাস্য। শিশু কেন্দ্রের পৌনে তিন শ কিশোরের ‘একাধিক পক্ষ’
থাকবে না, তা হতেই পারে না। আমরা একটি জিনিস ভুলে গিয়েছিলাম, তা হলো আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে যাঁরা নিয়োজিত, তাঁরা নিপুণ কথাশিল্পী। তাঁরা কল্পকাহিনি বানাতে পারেন। যেমন তঁাদের একটি অমর চরিত্র জজ মিয়া।

কেন্দ্রের হতাহতের ঘটনা নিয়ে যে কাহিনি ফাঁদা হয়েছিল, তা টিকল না। ২৪ ঘণ্টা না যেতেই সত্য উদ্‌ঘাটিত হলো। ‘দুই পক্ষের মারামারিতে’ নয়, ‘এক পক্ষের’ মারে প্রাণ হারিয়েছে তিনজন, জখম জনাপনেরো।

ঘটনার সর্বশেষ ভাষ্যে জানা যায়, ৩ আগস্ট কেন্দ্রের হেড গার্ড (আনসার সদস্য) তাঁর চুল কেটে দিতে বলেন এক কিশোরকে। ওই কিশোর চুল কেটে না দেওয়ায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে গালাগাল করলে কয়েক কিশোর মিলে হেড গার্ডকে মারধর করে।

ছেলেদের হাতে নিরাপত্তাকর্মী মার খেয়েছেন, অবশ্যই তার একটা বিচার হওয়া উচিত ছিল। যেসব ছেলে তাঁকে লাঞ্ছিত করে, তাদের শাস্তি প্রাপ্য। সে শাস্তি বিধি অনুযায়ী হবে। নমনীয় হতে পারে, কঠিনও হতে পারে। তবে মারের শাস্তি মার হতে পারে না। তার পরিবর্তে যা হয়েছে, তা এ রকম:

‘যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালক) গত বৃহস্পতিবার সকালে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রের ১৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, কেন্দ্রের প্রধান প্রহরীকে আঘাত করা কিশোরদের পেটাতে হবে অচেতন না হওয়া পর্যন্ত। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, একে একে ১৮ কিশোরকে আবাসিক ভবন থেকে ধরে আনা হয়। এরপর তাদের দুই হাত জানালার গ্রিলের মধ্যে আটকে, পা বেঁধে ও মুখে গামছা গুঁজে দিয়ে রড এবং ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে পেটানো হয়। এতে মারা যায় ৩ কিশোর, গুরুতর আহত হয় ১৫ জন। সেদিন দুপুরে তাদের খেতেও দেওয়া হয়নি।’ [প্রথম আলো]

পুলিশ সুপার আশরাফ হোসেন জানান, কেন্দ্রের কিশোরদের মারধরের ঘটনা ঘটে বেলা একটার দিকে। গুরুতর আহত কিশোরদের সারা দিন চিকিৎসা ছাড়া ফেলে রাখা হয়। সন্ধ্যায় নাঈম নামের এক কিশোর মারা গেলে তাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। তখনো কেন্দ্র থেকে কোনো তথ্য কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি। হাসপাতাল থেকে খবর পেয়ে সিভিল সার্জন ও একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল সেখানে যায়। তখন কিশোরদের ডরমিটরিতে গিয়ে দেখা যায়, মুমূর্ষু অবস্থায় অনেক কিশোর পড়ে আছে। তাদের পুলিশের পিকআপ ভ্যান ও অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এর মধ্যে আরও দুই কিশোর মারা যায়। পিটুনিতে অনেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জ্ঞান ফিরলে আবার তাদের পেটানো হয়। [প্রথম আলো]

কেন্দ্রের পাঁচ কর্মকর্তাকে কিশোর হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাঁরা হলেন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক, কারিগরি প্রশিক্ষক, ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর ও সাইকো সোশ্যাল কাউন্সিলর। তাঁদের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরের কোনো অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের সাধারণ কয়েদিদের কারাগারে না নিয়ে উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। উন্নয়ন কেন্দ্র বস্তুত সংশোধন কেন্দ্র। এ রকম প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তিনটি আছে। টঙ্গী ও যশোরের দুটি ছেলেদের জন্য, গাজীপুরেরটি মেয়েদের। এসব কেন্দ্রে যাদের পাঠানো হয়, তাদের অধিকাংশই শিশু তো নয়ই, কিশোরও বলা যায় না, রীতিমতো যুবক। যশোর কেন্দ্রে নিহত তিনজনের একজন ধর্ষণের আসামি, একজন হত্যা মামলার সঙ্গে যুক্ত। শিশু কেন্দ্রগুলোর অনাচার–দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন সময় সংবাদ হয়েছে।

শিশু কেন্দ্র যদিও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন, সাহারা খাতুন যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তখন তাঁর কাছে কিশোর সংশোধনাগার পরিদর্শন করতে মৌখিকভাবে আবেদন করেছিলাম। তিনি যে শুধু অনুমতিই দিয়েছিলেন তা–ই নয়, টঙ্গী বা যশোরে যাতায়াতের জন্য প্রয়োজন হলে গাড়িও দিতে চেয়েছিলেন। কোনো কারণে আমার ইচ্ছা পূরণ হয়নি।

পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা যায়, এই কেন্দ্রে এর আগেও অঘটন ঘটেছে। ‘২০১৪ সালের ৪ মে কাচের টুকরা দিয়ে ফালি ফালি করে নিজেদের শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে অভিনব প্রতিবাদ জানায় অন্তত ১৫ কিশোর। তারা কেন্দ্রের সাতটি সমস্যা সমাধানের দাবি তোলে। ওই দিন কিশোরদের হামলায় পুলিশের দুই সদস্যও আহত হন। সে সময় তারা অভিযোগ করে, তাদের যে পরিমাণ ভাত ও তরকারি দেওয়া হয়, তা খেয়ে পেট ভরে না। তা ছাড়া সেখানে শিক্ষার কোনো উপকরণ নেই, কর্মকর্তা ও পুলিশের সদস্যরা গালি দিয়ে কথা বলেন, অসুস্থ হলে ওষুধ না দেওয়া, অভিভাবকেরা দেখা করতে এলে তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়, দেখা করতে গেলে পুলিশকে টাকা দেওয়ার অভিযোগও তারা তুলেছিল। প্রায়ই কিশোরদের মধ্যে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে।’

[প্রথম আলো]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments